
ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেটের মধ্যে ঘুষোঘুষির এক পর্যায়ে সাংবাদিক জামাল খাসোগি মারা যান- এই ব্যাখ্যার দুদিন না যেতেই নতুন আরেক তত্ত্ব হাজির করেছে সৌদি আরব সরকার। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবের বলছেন মার্কিন টিভি ফক্স নিউজকে বলেছেন, সাংবাদিক খাসোগিকে খুন করা হয়েছে। তবে তিনি বলেন যুবরাজ মোহামেদ বিন সালমান সেই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেননি। তার কথা, নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু ‘দুর্বৃত্ত’ নিজেদের সিদ্ধান্তে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এদিকে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন সৌদি আরবের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। সৌদি কর্তৃপক্ষের স্বীকারোক্তি দেওয়ার এক দিন পর এই নতুন তথ্য দিলেন সৌদি কর্মকর্তা। ১৫ জন সৌদি কর্মকর্তার ইস্তাম্বুল যাওয়া, খাসোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রতিরোধের মুখে টুকরো টুকরো করার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে তথ্য দিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
সৌদি ওই কর্মকর্তা বলেন, কনস্যুলেটের ভেতরে জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয় এবং হত্যার পর খাসোগির পোশাক পরে এক কর্মকর্তা কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে যান। জামাল খাসোগি কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে গেছেন এটা প্রমাণ করতেই এমন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়।
সৌদি কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান মেজর জেনারেল আহমেদ আল-আসিরি ১৫ জনের দল গঠন করেন। জামাল খাসোগির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে বুঝিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল সরকার। এ জন্য ১৫ সদস্যের এ দলকে ইস্তাম্বুলে পাঠানো হয়। তাকে ফিরিয়ে আনতে শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বনের স্থায়ী আদেশ জারি ছিল ১৫ সদস্যের দলের প্রত্যেক সদস্যর প্রতি। তবে অনুমতি ছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল ১৫ জনের। দলটির পরিকল্পনা ছিল, ইস্তাম্বুলের বাইরে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খাসোগিকে আটকে রাখার হবে। শেষ পর্যন্ত যদি রিয়াদে ফিরতে না চান তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, ১৫ জনের দলে অনেক নির্দেশনা ছিল। কিন্তু শুরুতেই সবকিছু ভুল পথে পরিচালিত হতে থাকে। একপর্যায়ে কর্মকর্তারা আদেশ লঙ্ঘন করে দ্রুত সহিংস হয়ে ওঠেন। তারা খাসোগিকে কনসাল জেনারেলের কার্যালয়ে নেয়। যেখানে মাহের মুতরেব নামের এক কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি তর্কে জড়িয়ে পড়েন।
খাসোগি মুতরেবকে বলেন, যদি তিনি এক ঘণ্টার মধ্যে কনস্যুলেট ভবন থেকে বের না হন, তাহলে তুরস্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বাইরে থাকা তার বান্ধবী।
মুতরেব কূটনৈতিক নীতি-নৈতিকতা লঙ্ঘন করছেন উল্লেখ করে খাসোগি বলেন, আপনি আমার সঙ্গে কী করতে যাচ্ছেন। আপনি কী আমাকে অপহরণ করতে চান? মাহের মুতরেব বলেন, হ্যাঁ। আমরা তোমাকে ওষুধ দেব এবং এখান থেকে তুলে নিয়ে যাব। এরপর খাসোগি চিৎকার শুরু করলে তাকে শান্ত করতে মুখে কাপড় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চিৎকার থামানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে মারা যান খাসোগি।
ঘটনার ১৭ দিন পর ‘হাতাহাতির একপর্যায়ে খাসোগির মৃত্যু’ হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এর আগপর্যন্ত ঘটনার ব্যাপারে টানা অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল দেশটি।
তুর্কি মিডিয়ায় চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস
এদিকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বশেষ এই ব্যাখ্যার পরপরই তুরস্কের একটি সরকার সমর্থিত পত্রিকায় চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে যাতে ওই হত্যাকাণ্ডে পেছনে যুবরাজ সালমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ইয়েনি সাফাক নামে যে পত্রিকাটি গত দু-সপ্তাহ ধরে এ নিয়ে খবর ফাঁস করছে, তারা লিখছে, হত্যাকাণ্ডের পরপরই প্রভাবশালী সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাহের আব্দুল-আজিজ মুতরেব ইস্তাম্বুল থেকে যুবরাজ সালমানের অফিসে চার বার টেলিফোনে কথা বলেছিলেন।
পত্রিকাটি আরো বলছে, মুতরেব ওয়াশিংটনেও একটি ফোন কল করেছিলেন, এবং “সম্ভবত ওই ফোনটি তিনি করেছিলেন সৌদি রাষ্ট্রদূত খালেদ বিন সালমানকে।” রাষ্ট্রদূত খালেদ বিন সালমান যুবরাজ সালমানের ছোট ভাই।
এই ঘটনা নিয়ে যে ১৮ জনকে সৌদি আরবে আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মাহের আব্দুল আজিজ মুতরেবও রয়েছেন।
বিবিসির তুর্কি ভাষা বিভাগ বলছে, ইয়েনি সাফাক যে তথ্য ফাঁস করেছে, তা কি ফোন কলে আড়ি পেতে পাওয়া, নাকি হত্যাকাণ্ডের কথিত অডিও রেকর্ডিং থেকে পাওয়া তা এখন নিশ্চিত নয়। পত্রিকাটি সূত্র গোপন রেখেছি। অবশ্য এ পর্যন্ত এ নিয়ে তুরস্ক এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে যেসব তথ্য ফাঁস হচ্ছে, তা সূত্র গোপন রেখেই করা হচ্ছে।
ইয়েনি সাফাক গত রোববার খবর দিয়েছিল, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেটের মধ্যে তাকে হত্যা করার আগে খাসোগিকে টেলিফোনে যুবরাজ সালমানের সাথে কথা বলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে সময়, যুবরাজ তাকে সৌদি আরকে ফেরার কথা বলেন। খাসোগি যখন তাতে রাজি হননি, তখনই তাকে হত্যা করা হয়।
বিবিসি তুর্কি বিভাগের সাংবাদিকরা বলছেন, এটা পরিষ্কার যে তুরস্কের সরকার চাইছে এসব ঘটনা ফাঁস হোক, এবং ইয়োনি সাফাক পত্রিকা সেই কাজই করছে। ইয়েনি সাফাক পত্রিকার ফাঁস করা সর্বশেষ এসব তথ্য নিয়ে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এখনও কোনো বক্তব্য শোনা যায়নি।
তবে ঘুষোঘুষির সময় খাসোগি দুর্ঘটনাবশত মারা যান বলে রবিবার সৌদি আরবের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে তুরস্ক। প্রেসিডেট এরদোগানের একজন উপদেষ্টা ইয়াসিন আকতে বলছেন, ‘সৌদিরা তুরস্কের বুদ্ধিমত্তাকে উপহাস করছে।’
তিনি বলেন, সৌদি এই ব্যাখ্যায় কোনো সত্যই উদঘাটিত হয়নি, বরঞ্চ নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, আগামীকাল (মঙ্গলবার) তিনি নিজে সংসদে এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ‘নগ্ন সত্য’ প্রকাশ করবেন।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবের ফক্স নিউজের সাথে সাক্ষাৎকারে বলার চেষ্টা করেছেন, কিছু মানুষ নিজের সিদ্ধান্তে এই অপরাধ ঘটিয়েছে এবং এর সাথে সৌদি নেতৃত্বের কোনো সম্পর্কই নেই।
তিনি বলেন, ‘এই মানুষগুলো তাদের ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করেছে..অবশ্যই সাংঘাতিক ভুল হয়েছে এবং কেউ ভুল ঢাকতে গিয়ে আরো ভুল করেছে তারা।আমরা সত্য উদঘাটনে এবং অপরাধীদের সাজা দিতে বদ্ধপরিকর।’
খাসোগির হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সৌদিদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দেওয়া পরস্পরবিরোধী নানা ব্যাখ্যা তাদের পশ্চিমা মিত্ররাও গ্রহণ করেনি। শনিবার ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যিনি সৌদি রাজপরিবারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত, বলেছেন, সৌদিদের বিভিন্ন বক্তব্যে ‘মিথ্যা’ এবং ‘প্রতারণা’ রয়েছে। বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি রোববার এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, খাসোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে তারা সৌদি আরবের কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা চায়।